কক্সবাজারে প্রায় ৩ বছর পর জন্মনিবন্ধন ফের চালু

এম. বেদারুল আলম ◑

অবশেষে খুলে দেওয়া হল কক্সবাজার জেলার জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম। জেলার ৭১ ইউনিয়ন এবং ৪টি পৌরসভার মধ্যে গতকাল ৩১ আগষ্ট ১২টি ইউনিয়নে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন বন্ধ এ কার্যক্রমের ফের সুচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের স্থানীয় সরকার শাখার উপ পরিচালক শ্রাবস্তি রায়।

এর আগে গত শুক্রবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব কক্সবাজারের কৃতি সন্তান হেলালুদ্দিন আহমদ শীঘ্রই জেলাবাসীর কাংখিত জন্ম নিবন্ধন খুলে দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দেন। ফলে জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের কাংখিত সরকারের এ পরিসেবা চালু হলো। প্রাথমিক ভাবে জেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা আগমণের কারণে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পুরো কক্সবাজার জেলায় জন্মনিবন্ধন কার্যত্রম বন্ধ করে দেয় সরকার। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা স্রোতের কারণে এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় যেন কৌশলে রোহিঙ্গারা জন্মনিবন্ধন করতে না পারে।

স্থানীয় সরকার শাখার উপ পরিচালক শ্রাবস্তি রায় জানান, কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের কাংখিত জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম ১২টি ইউনিয়নে গতকাল ৩১ আগষ্ট থেকে চালু করা হয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এটি। ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে প্রথম ধাপে ১২টি ইউনিয়ন পরিষদে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদসমুহ হলো টেকনাফের হোয়াইক্ষং, উখিয়ার হলদিয়াপালং এবং রতœাপালং। কক্সবাজার সদরের ১০টির মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন যথা ঝিলংজা, পিএমখালী, ভারুয়াখালী, চৌফলদন্ডী, জালালাবাদ, খুরুস্কুল, ইসলামাবাদ এবং পোকখালী। ডিডিএলজি জানান, আগের মত জন্মনিবন্ধনের জন্য প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবরে আবেদন করতে হবে।
আবেদন পরিষদ থেকে উপজেলা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন যাছাই বাচাই কমিটির বরাবরে উপস্থাপন করার পর কমিটি গুরুত্বসহকারে যাছাই করে সঠিক হলে পুণরায় অনুমোদন দিয়ে পরিষদে পাঠাবে। পরিষদ তা আবেদনকারীকে চেয়ারম্যান এবং পরিষদের স্বাক্ষরে সনদ প্রদান করবে। প্রতিটি উপজেলায় শক্তিশালী বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা সবদিক বাছাই করে চূড়ান্ত করে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান করবেন।

মিসেস শ্রাবস্তি রায় জানান, রোহিঙ্গাদের যদি কোন চেয়ারম্যান বা পরিষদের পক্ষ থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হয় বা ইস্যুর পর যদি প্রমাণিত হয় তা ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে। উক্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে জেল জরিমানা এমনকি কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হবে।

মিসেস শ্রাবস্তি রায় আরো জানান, ইতোমধ্যে ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাগণের হাতে পাসওয়ার্ড পৌছে দেওয়া হয়েছে। তারা ইউনিয়ন পরিষদের প্রোভাইডারদের হাতে তা প্রদান করবেন। উক্ত ইউনিয়ন পরিষদ সমুহে এখন থেকে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন স্থানীয় জনসাধারণ।

এদিকে কক্সবাজার সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদ উল্লাহ মারুফ জানান, সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন পরিষদে আমরা জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম চালুর অনুমতি পেয়েছি। বাকি ২টি ইউনিয়ন পরিষদের পাসওয়ার্ড এখনো পায়নি। ইউনিয়ন ২টি হলো ইসলামপুর এবং ঈঁদগাও। এ ২টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পরিষদের সচিবের জন্মনিবন্ধন অনলাইনে না থাকায় তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারা অনলাইন করলে তাদের এলাকার লোকজন এ সেবার আওতায় আসবে। চেয়ারম্যান এবং সচিবের জন্মনিবন্ধন যদি অনলাইনে পাওয়া যায় উক্ত পরিষদকে জন্মনিবন্ধনের সার্ভার খুলে দেয়া হচ্ছে বলে উক্ত ইউএনও জানান।

অপরদিকে জেলা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সমিতির সভাপতি মোঃ শিহাব উদ্দিন জানান, গত শুক্রবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদের জন্য লাপটপ, মডেম এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস বিতরণ করেছেন সচিব হেলালুদ্দিন স্যার। সেখানে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের স্বচ্ছতার বিষয়ে। আমরা উক্ত নির্দেশনা পালন করে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পুণরায় শুরু করব। জেলাবাসির দীর্ঘদিনের দাবি যেহেতু মেনে এ কার্যক্রম চালু করা হয়েছে আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে নিরলসভাবে কাজ করব।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলিম নিধনের পর কক্সবাজারে রোহিঙ্গার ঢল নামে। পরে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যায়। অনেকে কৌশলে রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন করতে মোটা টাকায় জড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের হাত থেকে স্থানীয় জন্মগোষ্ঠিকে রক্ষায় সরকার জন্ম নিবন্ধন বন্ধ করে দেয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গারা টেকনাফ –উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এর পরের মাসে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার কক্সবাজার জেলার জন্ম নিবন্ধন সার্ভার বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে বন্ধ রাখা হয় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন। রোহিঙ্গাদের কারণে দীর্ঘ ২ বছর ১১ মাস বন্ধ থাকা জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম আবার আলোর মুখ দেখলো। কাংখিত এ কার্যক্রম যেন সঠিন এবং স্বচ্ছ হয় কোন রোহিঙ্গা যেন জন্মনিবন্ধন করতে না পারে সে দিকে সর্তক থাকার আহবান জানান কক্সবাজারের স্থানীয় সরকার শাখার উপ পরিচালক মিসেস শ্রাবস্তি রায়।

উল্লেখ্য গত বছরের ৮মে দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘২০ মাস ধরে বন্ধ জন্ম নিবন্ধন’ শীর্ষক প্রতিবেদন যুক্ত করে গত বছরের ২৯ অক্টোবর একটি রিট করেন এডভোকেট নাসরিন ছিদ্দিকা লিনা। যার নম্বর ১১৩৫১/২০১৯। রিটে জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া পুনরায় চালুর নির্দেশনা চাওয়া হয়।

রিটের প্রেক্ষিতে কক্সবাজার জেলার চারটি পৌরসভা ও ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করতে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এই এলাকাগুলোয় জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। স্থানীয় সরকার সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, নির্বাচন কমিশন, রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যু), চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে চার সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।